রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ শুধু তাৎক্ষণিক সহিংসতা নয়, বরং দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি নতুন প্রতিচ্ছবি। শুক্রবার (২৯ আগস্ট) বিকেল থেকে রাত অবধি চলা এই সহিংসতায় আহত হয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের শীর্ষ নেতা নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানসহ অনেকে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও ঘটনাটি আগামী দিনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন উত্তেজনা যোগ করেছে।
রাজনৈতিক উত্তাপের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে বিরোধী দলগুলো একদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে চাপে রাখতে চাচ্ছে, অন্যদিকে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে চাইছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি সংসদীয় রাজনীতির অংশ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। অপরদিকে গণঅধিকার পরিষদ, যারা তরুণ প্রজন্মের ‘বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি’ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, তারা রাজপথে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের কৌশল নিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে কাকরাইলের ঘটনাটি কেবল দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব নয়, বরং বিরোধী শিবিরের অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা ও অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ : দায় কার ?
ঘটনার পরপরই দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে দায় চাপিয়েছে।
এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ প্রমাণ করে, রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সহিংসতার দায় নিজেদের কাঁধে নিতে প্রস্তুত নয়। বরং দোষ চাপিয়ে দিয়ে তারা নিজেদের কর্মীদের ‘ভিকটিম’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা
সংঘর্ষের খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের বিপুল সংখ্যক সদস্য ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তবে প্রশ্ন উঠছে—রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে দিনের পর দিন উত্তেজনা বাড়লেও কেন সংঘর্ষ শুরুর আগে তা ঠেকাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী? শুধু ঘটনার পর নিয়ন্ত্রণ নয়, প্রতিরোধমূলক ভূমিকা রাখার বিষয়েও সমালোচনা রয়েছে।
জনসাধারণের ভোগান্তি ও আতঙ্ক
এ ধরনের সংঘর্ষ সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বয়ে আনে। কাকরাইলের মতো ব্যস্ত এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, যান চলাচল থেমে যায়, মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। রাজধানীবাসীর মনে প্রশ্ন—রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের এই খেসারত বারবার কেন তাদেরই দিতে হচ্ছে?
বিশ্লেষণ : বিভক্ত বিরোধী রাজনীতি
বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতির একটি বড় সমস্যা হলো ঐক্যের অভাব। ক্ষমতাসীনদের মোকাবিলায় একসঙ্গে দাঁড়ানোর বদলে বিরোধী শিবিরের ভেতরেই চলছে শক্তি প্রদর্শন আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। জাপা ও গণঅধিকার পরিষদের সংঘর্ষ সেই বিভক্ত রাজনীতির নগ্ন রূপ।
গণঅধিকার পরিষদ তরুণদের আকর্ষণ করতে চাইছে আন্দোলন ও মিছিলে, অন্যদিকে জাপা চাচ্ছে তাদের ঐতিহ্যগত অবস্থান ধরে রাখতে। এর ফলে বিরোধী রাজনীতি একধরনের “অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা”তে পরিণত হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত সরকারকেই শক্তিশালী করছে।
কাকরাইলের সংঘর্ষ কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি ইঙ্গিত করছে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের ভাঙন, সহিংস সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি এবং গণমানুষের স্বার্থের প্রতি অবহেলার। রাজনীতিবিদরা যদি নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঊর্ধ্বে উঠতে না পারেন, তবে এর খেসারত দিতে হবে সাধারণ জনগণকেই।